Friday, March 23, 2012

স্বাধীনতার চল্লিশ বছর: প্রশ্নবিদ্ধ দেশপ্রেম

২৬শে মার্চ এলেই মনে পড়ে একটি বিজয়,আত্মত্যাগ,বেঁচে থাকার আকুলতা ও প্রেরণার দ্বীপশিখা। এদিনই পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অন্য কোনো রাষ্ট্রের মত ঔপনিবেশিক সরকারের সাথে দলিল দস্তাবেজ নিয়ে আলোচনার টেবিলে এ রাষ্ট্র স্বাধীন হয়নি। এদেশের আপামর জনতা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দখলবাজদের কবল থেকে মাতৃভূমি উদ্ধার করেছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪০টি বসন্ত অতিক্রম করেছে। একটি প্রজন্ম অতিবাহিত হয়ে আরেকটি নতুন প্রজন্মের সূচনা ঘটেছে। কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে যে স্বপ্ন ও স্বাধ একসময় দেশবাসী দেখেছিল আজও তা বাস্তব কুসুমে প্রস্ফুটিত হয়নি। আজও পরাধীনতা ও বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বিরাজমান কলুষিত রাজনীতির কবলে এখনো পরাধীনতার গন্ধ আলো-বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।

উন্নয়নের পথে অগ্রগ্রামী হওয়ার প্রাক্কালে বিভিন্ন অশুভ শক্তির প্ররোচনা ও বাধায় বারবার হোঁচট খাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। দেশে সর্বত্র এখন বহুমূখী ও সর্বব্যপী র্সবনাশের ঘন্টাধ্বনি বাজছে।
যে দেশের স্বাধীনকামী মানুষের রক্তে ও মননে ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙের ফেলার প্রয়াস সেই সকল প্রাণ পুরুষের উত্তরসূরীদের তথাকথিত স্বার্থান্বেষী রাজনীতির নির্মম বলি হচ্ছে তাদের ধ্যান-ধারণা ও স্বপ্নের।
দেশমাতার স্বার্থসিদ্ধি বিলিয়ে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তথাকথিত রাজনীতিক কপটতার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে হাজারো মীর জাফর আর ঘসেটিদের। আর তারা উঠে পড়ে লেগেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়।

ফলস্বরুপ চলমান রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অচলায়ন অবস্থা চলছে। এর আবরণে রাজনৈতিক প্রহসনের ঘটনা ঘটছে। রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় এখন আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে। স্বাধীনতা প্রশ্নে যেখানে সবাই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ভূলে কাধে কাধ মিলিয়ে অনাহারে, উপবাসে দেশকে হানাদার মুক্ত করেছিলেন সেখানে ৪০বছর পর সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতির ধারা উপধারা।
হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের। একপক্ষ ক্ষমতায় অধিষ্ঠ আর অপর পক্ষ তা লাভে বিভোর।

একদিকে ক্ষমতাসীনদের একদর্শিতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া দলন, শিশু কিশোর নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অঙ্গসংগঠনের বেপরোয়া আচরণসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখন মলিন। তাদের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গরম না পড়তেই তীব্র লোডশেডিং, প্রশাসনকে দলীয়করণ, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, শেয়ারবাজারে ধস, বিনা মূল্যে অন্য দেশকে ট্রানজিট প্রদান, উদার গণতান্ত্রিক ধারণা, অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির উত্তরণের নামে একটা ঘোলাটে ও বিভাজন অবস্থার সৃষ্টি করছে।

সমাজের অভ্যন্তরে টিকে থাকা এরুপ বিভাজিত নানা শক্তির সয়লাব ও বাস্তবতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যা আগে এতটা স্পষ্ট দৃঢ় ও সুসংগঠিত ছিল না। একের পর এক মতার পট পরিবর্তন, অশুভ এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিরা ও নিরাপত্তা নীতি, শিক্ষানীতি বিশেষ করে শিক্ষানীতিকে ইসলামমুক্ত করে পশ্চিমা ধাঁচে সাজানো, দেশের মুক্ত বুদ্ধিভিত্তিক সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গড়তে সেক্যুলার অপসংস্কৃতির সয়লাব সৃষ্টি করছে। এর কারণে যারা আত্মিক টানে দেশের ঐতিহ্যের লালন এবং ভারতীয় নাশকতা-আগ্রাসন থেকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রায় বদ্ধপরিকর ছিলেন, তাদেরকে আজ স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী জঙ্গিবাদদের দোসর হিসেবে নির্মূলের জন্য টার্গেট করা হয়েছে। সবকিছুকে দলীয়করণ ও ঢেলে সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। অপরদিকে বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিও দিল্লি তুষ্টে আবর্তিত। জনগণের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিকিয়ে তার অভিভাবকত্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সরকার একরকম উঠে পড়ে লেগেছে। বিনা শুল্কে ট্রানজিট প্রদান করে যে সখ্যতা সরকার তৈরি করেছে তার বদৌলতে সীমান্তে ফেলানীর মতো শান্ত পাখিরা দিনের পর দিন লাশ হচ্ছে। কাউকে আবার গুম করে রাখা হচ্ছে তার কোনো হিসেব নিকেশ ও প্রতিবাদ জানানোর মতো যেন দায়িত্ব সরকারের নেই।

আর বরাবরের মত অপর শক্তি তথা বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও সর্বাবস্থায় সরকারের নয় রাষ্ট্রেরও বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত। সরকার পতনের নামে হরতাল,ভাংচুরসহ বিভিন্ন দীর্ঘ কর্মসূচী ডেকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও জনগণের রাজনীতির ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিচ্ছে।বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে দেশকে বিভাজিত করার দিকে টেলে দেয়া হচ্ছে।

এসবের কারণে বরাবরের মতো বাংলাদেশের নেতিবাচক খবর হিসেইবেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। এমনকি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যে ৩৭টি দেশের তালিকা তৈরি হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসিসহ বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের বর্তমান কলুষিত চিত্র ফুটে উঠেছে ।
আর রাজনীতির এমন সূচীর প্রভাব পড়েছে দেশের হাটে-ঘাটে, শিক্ষাঙ্গনে। এর মধ্যে সাম্প্রতিককালে স্বার্থান্বেষী রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে শিক্ষকদের নিষ্প্রভ দেহে। শিক্ষকরা এখন শিক্ষাদানের মত মহান পেশাকে কলুষিত করছেন। তাদের কাছে আজ শিক্ষার্থীরাও নিরাপদবোধ করছে না। তাদের রাজনীতি সূলভ আচরণে বেপরোয়া হওয়ায় স্বয়ং শিক্ষার্থীরা দিক ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হচ্ছে। যাদের বদৌলতে শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব ও কর্তব্য বেমালুম ভূলে কলমের বদলে হাতে অস্ত্র নিয়ে মরণ খেলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে। তাদের সংঘাতে ক্যাম্পাসে মারামারি, সংঘর্ষ, হত্যা ও চাদাবাজি, টেন্ডারাজি এখন নৈত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নিরীহ মেধাবীরা অকালে ঝরে পড়ছে। দেশ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় যোগ্য দায়িত্বশীল।

দেশের চলমান রাজনীতি উত্তরণ বিশ্লেষণে যে বিষয়টি ফুটে উঠে তা নিয়ে আমাদের জাতিসত্ত্বা ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। যে সংগ্রাম আর স্বপ্ন ধারণ করে দেশকে শত্রু মুক্ত করা হয়েছিল আজ সেই দেশে একই ভৌগলিক এরিয়ায় একই সীমানায় জন্ম নিচ্ছে আত্মকলহ, বিভক্তি ও বিভাজন। আর ত্যাগীর বদলে বিশ্বের কাছে আমরা পরিচিত হচ্ছি নিচু মনমানসিকতার জাতি হিসেবে। আর এসবের ক্ষেত্রে সুযোগ নিচ্ছে দখলবাজ ও দেশবিরোধীরা।

এতাবস্থায় বিরাজমান রাজনীতিতে উদারনীতির নামে প্রহসনের অবস্থা চললে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনের মত লালিত স্বপ্নও ধূলিস্মাৎ হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। আর আগামীতে গণতন্ত্রের ধারা কতটুকু বিরাজমান থাকবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় দেখা দিয়েছে।
আগামী সোনালী দিনের রাজনৈতিক সূচি ও বাস্তবতা এখন নির্ভর করছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ও বিরোধী দলের সতর্ক দৃষ্টির উপর। ২৬ মার্চের চেতনায় উদ্ধুব্ধ হয়ে সব রকম বিভেদ-বিচ্ছেদ ভূলে সংকীর্ণ ও স্বার্থ চিন্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশগড়ার কাজে সকলের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা। এক্ষেত্রে আত্মবিলাস ও আত্মতুষ্টি নয় বরং জনগণের কাম্য বিষয়কে সচেতনভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশ ও দশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতিকে বেগবান করা হলো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারার পরিচায়ক।

No comments:

Post a Comment